রাজধানী দিল্লিতে রয়েছে দুটি মিনার- কুতুব ও আলাই মিনার। যা প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হয়েছে বারবার। যখনই দিল্লির কুতুব চত্বরে গেছি, ভেসে উঠছে সেখানে লুকিয়ে থাকা প্রায় সহস্রাব্দি পুরোনো সেই নীরব ইতিহাস।
কুতুব চত্বরে রয়েছে দুটি মিনার। একটি পূর্ণাঙ্গ, একটি কঙ্কালসার পাথরের ঢিবি। কুতুব মিনার ও আলাই মিনার। আসুন দেখে নিই সেই দুটি মিনারের জন্মকথা বা ইতিকথা।
কুতুবমিনার নিয়ে সচরাচর প্রচলিত একটি ভ্রম প্রথমেই ভেঙ্গে দিতে চাইছি । যেহেতু কুতুবমিনারের নির্মাণ কাজ শুরু করেছিলেন কুতুবউদ্দিন আইবেক, তাই অনেকেরই ধারণা কুতুবউদ্দিন এটি নিজের নামে নামকরণ করেছিলেন। কিন্তু বিষয়টি আদৌ তা নয়। হ্যাঁ, কুতুব মিনারের পরিকল্পনা স্থাপনা এবং বৃহৎ অংশের নির্মাণ করিয়েছিলেন কুতুবউদ্দিন আইবেক।
কিন্তু তার নামকরণ করেছিলেন তাঁর আধ্যাত্মিক গুরু কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকীর নামানুসারে। এবং এটি নির্মাণ করিয়েছিলেন কোনো স্মৃতিস্তম্ভ হিসেবে নয়, বরং চত্বরে ভগ্নাবশেষ পড়ে থাকা ‘মসজিদে ক্বুওয়াতুল ইসলাম’-এরর মিনার হিসেবে। আযান দেওয়ার জন্য । মসজিদটি কুতুবুদ্দিন নির্মাণ করিয়েছিলেন ১১৯৮ খ্রিস্টাব্দে।
কুতুব মিনারের উচ্চতা ৭২.৫ মিটার, অর্থাৎ প্রায় ২৩৮ ফুট। ইটের তৈরি বিশ্বের উচ্চতম মিনার। তলায় যার ব্যাস ১৪.৩ মিটার অর্থাৎ ৪৭ ফুট। চুড়ায় ব্যাস ২.৭ মিটার বা প্রায় ৯ ফুট। উপরে উঠার জন্য মিনারের ভিতর দিয়ে রয়েছে ৩৭৯ টি সিঁড়ি। কুতুবউদ্দিন আইবেক ১১৯৯ খ্রিস্টাব্দে কুতুব মিনারের কাজ শুরু করেছিলেন। ১২২০ খ্রিস্টাব্দে জামাতা শামসুদ্দিন আলতামাস সম্পন্ন করেন এর নির্মাণকাজ।
Also Read, Happy New Year Wishes
১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত দর্শনার্থীদের মিনারে চড়ার পাস দেওয়া হতো। কিন্তু চুরাশির ডিসেম্বরে এক অনভিপ্রেত ঘটনার পর থেকে মিনারের প্রবেশ পথে তালা লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেদিন প্রায় চারশো প্রর্যটক কুতুব মিনারের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছিলেন। হঠাৎ বিদ্যুৎ বন্ধ হয়ে আঁধার হয়ে যায় মিনারের ভেতর। পর্যটকদের মধ্যে এক ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। সবাই একসঙ্গে নিচে নেমে আসতে চায়। হুড়োহুড়ি করতে গিয়ে সেদিন পঁয়তাল্লিশ জন পর্যটকের প্রাণহানি ঘটে- যার অধিকাংশই ছিলেন শিশু।

কুতুব চত্বরেই ভগ্ন মসজিদের উত্তর পার্শ্বে রয়েছে সাত মিটার উঁচু আলাই মিনারের এক ভগ্নাংশ। অনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং দম্ভের প্রতীক হয়ে। সুলতান আলাউদ্দিন খিলজী(১২৯১-১৩১৬), যিনি নিজেকে দ্বিতীয় আলেকজান্ডার অর্থাৎ (সিকন্দর-এ-সানি) বলে ভাবতেন, নিজের ক্ষমতা আর বিস্তৃত সাম্রাজ্য নিয়ে এতটাই গর্বিত ছিলেন যে তার ঐকান্তিক বাসনা হয়ে দাঁড়িয়েছিল যে করেই হোক কুতুবউদ্দিন আইবেক নির্মিত কুতুব মিনারকে নীচু দেখানো।
তাই তিনি আরম্ভ করলেন তার দম্ভের মিনার। কুতুব মিনারের ডাবল ব্যাস দিয়ে চারগুণ উচ্চতার মিনার তৈরীর বাসনায়। নাম দিলেন ‘আলাই মিনার’ ! বাসনা ছিল- তার গর্বের মিনার তাকে করে তুলবে চিরঞ্জীব, অমর !
কিন্তু দম্ভের সকল রাশ যে তার হাতে নয়, একথা হয়তো তার জানা ছিল না। অথবা মনে ছিলনা। ‘তারিখ-ই-আলাই’ গ্রন্থে আমির খসরু আলাউদ্দিন খিলজির বাসনা ব্যক্ত করেছেন এভাবে- “এই মিনার কে এত উঁচু করে গড়ে তুলো, যাতে কোন কালেও কেউ তা অতিক্রম করতে পারে না।”
১৩১৩ খ্রিস্টাব্দে প্রারম্ভ করা আলাই মিনার মাত্র ২৩ ফুট নির্মাণকার্য সম্পন্ন হবার পরই ১৩১৬ খ্রিস্টাব্দে নির্বাপিত হয়ে যায় সেই দাম্ভিকের জীবনপ্রদীপ! দন্ত বের করে জোড়াতালি দেওয়া আলাই মিনার নামক সেই পাথরের টুকরোগুলো আজও উপহাস করছে জগতের সকল দাম্ভিককে, আর শুনিয়ে দিচ্ছে- ‘চিরদিন কাহারো সমান নাহি যায়’!
By এ এফ এম ইক্ববাল, এইচ. এম লোদি হাই স্কুল, হাফলং